বাড়িকক্সবাজারকক্সবাজারে শতাধিক অবৈধ ইটভাটার কবলে পড়ে বিপর্যয়ের মুখে কৃষি জমি

কক্সবাজারে শতাধিক অবৈধ ইটভাটার কবলে পড়ে বিপর্যয়ের মুখে কৃষি জমি

নিউজ ডেস্কঃ-

কক্সবাজারে কৃষি জমি ধ্বংস করে টপ সয়েল উত্তোলন ও ফসলি জমির পাশেই অবাধে গড়ে উঠছে ইটভাটা। নিয়ম নীতি কোন বালাই নেই এখানে। ইট উৎপাদন অনুমতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেই এসব ইট ভাটায়। অবৈধ ভাবে ব্যবহার হচ্ছে বিদ্যুৎ আর দেদারছে পুড়ছে কাঠ। শ্রম আইনকেও দেখানো হচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে রাজস্ব আয় থেকেও করা হচ্ছে বঞ্চিত। কাটছে ফসলি জমি ও সরকারি জমির মাটি। এতে করে ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি। এহচ্ছে কক্সবাজারের ইটভাটার চিত্র।
এ ছাড়া ইট তৈরীর মাটির জন্য দেদার কাটছে ফসলি জমির উপরি অংশ। ফলে প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে চাষাবাদের জমির উর্বরতা। প্রভাবশালী কিছু মালিক সরকারি খাস জায়গার মাটি, বাঁকখালী নদীর পাড়ের মাটি নিচ্ছেন ভাটায়। মোটা অংকের টাকায় সবকিছু রফাদফা করেই এখানে চলছে দেড় শতাধিক ইটভাটা। এনিয়ে স্থানীয় প্রশাসন নীরব। ইট উৎপাদন আর সরকারী ভ্যাট দেওয়ার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব।
রামু উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিস সূত্রে জানা গেছে, রামু উপজেলার ফতেঁখারকুল, খুনিয়াপালং, কাউয়ারখোপ, রশিদ নগর, চাকমারকুল, ঈদগড়, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী, ঝিলংজা, ঈদঁগাওতে রয়েছে অর্ধশত ইটভাট।
এছাড়া উখিয়া উপজেলা, চকরিয়া ও বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আরো ৩৮ টি ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটাই জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে পড়েছে। ঘনবসতি ঘেষা ইটভাটা গুলোর নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। ইট উৎপাদনের কোন অনুমতিও দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কোন রকমে অনিয়মিত একটি কাগজ হাতে পেলেই, ওই কাগজটির বলে ভিন্ন নামে চলছে একাধিক ইটভাটা। আর রামু ও কক্সবাজার সদরের অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে উঠেছে সড়ক মহাসড়ক ও নদীর পাড়ে। ফসলি জমির মাঝখানে। কিছু এলাকায় ইটভাটা গিলে খাচ্ছে নদী।
অনুসন্থানে জানা গেছে, এক লাইসেন্সেই চলছে ভিন্ন নামের ৪-৫টি ইটভাটা। বৈধ কাগজ না থাকলেও রয়েছেন ভাড়াটিয়া মালিক। মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সই চড়া দামে চলছে ক্রয়-বিক্রয় ও ভাড়া দেয়ার কাজ। কাগজের ইটভাটার নামের সাথে ইটের নামের মিল নেই। রামুতেই রয়েছে এধরনোর অসংখ্য ইটভাটা। জামান ব্রিকমিল হয়ে যাচ্ছে রামু লাইন ব্রিকস। আবার ওই ব্রিকস ফিল্ড কখনো হয়ে যাচ্ছে ডাব্লিউ জেট ব্রিকস ও আসিফ ব্রিকস। এম আর সি নামের ব্রিকস ফিল্ড হয়ে যাচ্ছে পিবিসি।
কয়েকজন ব্রিক ফিল্ড মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইটের গায়ের ইংরেজি অক্ষরের শব্দ বলতে গিয়ে দাঁতে ঠোঁটে কাঁপন ধরে যায় অনেক ভাটা মালিকের। কিছু মালিক দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত আর বলতেই পারেননি। বেশ কিছু ভাটায় রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। ব্যবহার হচ্ছে মনগড়া অবৈধ চিমনি, নামে ঝিকঝাক হলেও বাস্তবে রূপ ভিন্ন। উড়ছে বিষাক্ত ধুয়া ও বালি। নষ্ট হচ্ছে বসত ঘরের চাল আসবাবপত্র ও কাপড় চোপড়। রোগাক্রান্ত হচ্ছে ইটভাটা সংলগ্ন বাড়ি ঘরের শিশু সহ নানা বয়সের লোকজন।
বসত বাড়ি ঘেষে গড়ে উঠা ইটভাটার মালিক শবিউল হক ১৫ বছর আগে এমবি ব্রিকস নামের একটি লাইসেন্স এক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন । ওই লাইসেন্সের অনুবলেই তিনি একে একে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা এলাকায় ২-৩ টি ইট ভাটা চালু রেখেছেন। স্থায়ী হননি বেশী দিন। রামু রশিদ নগর পানিছড়া সড়কের পাশে জামান ব্রাদার্স কাগজের উপর ভর করেই রামু লাইন নামের একটি ভাটা চালু করেন। এক বছর পর সেই ভাটাটি ভাড়া দেয়া হয়। সেখান থেকে চলে যান অন্য জায়গায়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে হক নাম দিয়ে আরেকটি ব্রিকস ফিল্ড চালু করেন। গত বছর রামু এবং কক্সবাজার সদরের বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমির মাঝখানে কয়েক ডজন ইটভাটা গড়ে উঠে।
বৈধ সকল কাগজপত্র না থাকলেও যেখানে-সেখানে মনগড়া ইট তৈরী করছেন। কখনো জেট এইচ টি কখনো এমবিসি নামের ইট তৈরী করছেন। সেখানকার অধিকাংশ কৃষক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় বিচার শালিস করেও কোন প্রতিকার পায়নি। সদরের পিএমখালী গ্রামের ডিক পাড়ায় এম আর সি ব্রিকসের বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় কৃষি জমি ধবংস হতে থাকলে স্থানীয় কৃষকরা প্রতিকার চেয়ে সদও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। দীর্ঘদিন ঘুরেও কোন সুফল পায়নি সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
এই ইট ভাটা মালিক মোবারক হোসেন বলেন, এক লাইসেন্সে একাধিক নামে ব্রিকস ফিল্ড চালানো যায়। অন্যগুলো হচ্ছে মূল ইটভাটার ব্রান্ড।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে রামুতে গত ৭-৮ বছর ধরে চলছে নীপা নামের ব্রিকস। লাইসেন্স বিহীন ওই ইটভাটাটি বসত বাড়ি ও মাঠের ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ভ্রাম্যমান আদালত তাদের জরিমানা করেন। এরপরও থেমে নেই তারা। ফসলি জমি ও সরকারি জায়গার মাটি কাটছেই। সড়ক ঘেষে রেখেছে কয়লা। শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে শিশু শ্রম। তাদের আইনি সকল কিছুই প্রক্রিয়াধীন হলেও কিন্তু উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। গত ৫/৬ বছর ধরে ইটভাটার আশপাশের বোরো ফসল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। গত মৌসুমে ধান পাকা শুরু হলে কৃষকরা অধিক মাত্রায় ক্ষতির সম্মুখিন হন। গত বছর প্রায় ৫০ একর জমির বোরো ধানে চিটা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সমাবেশসহ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ হয়। কিন্তু পরে উপজেলা প্রশাসন পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাদের ভূমিকা কৃষককুলে সন্দেহের জন্ম দেয়। তৎসময় প্রশাসন কথা দিয়ে ছিল, কথা ছিল ফসলি জমি থেকে এটি সরিয়ে নেওয়া হবে, কিন্তু তা অদ্যবদি কার্যকর হয়নি।
চাকমারকুল গ্রামের বাসিন্দা সোহাব উদ্দিন, নুরুল আমিন সহ অনেকেই বলেন, ইটভাটার ধুলা আর কালো ধোঁয়ায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মালিক পক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। রামু সদরের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের পাশে ভুতপাড়া গ্রামের জন বসতি সংলগ্ন স্থানে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে সফল হক ব্রিকস, বিকেবি, বিবিএ নামের ইটভাটা। পাশেই চলছে এইচবিএম নামের ব্রিকস। এই ব্রিকসের প্রকৃত মালিক ছিলেন শফিউল হক। কোন বৈধতা না থাকলেও ভাড়া দিয়ে সটকে পড়েন তিনি। আক্তার নামের এক ব্যক্তি এইচবিএম ব্রিকসের নাম পাল্টিয়ে আসিফ নাম দিয়ে ইট তৈরী অব্যাহত রেখেছেন। আর সরকারি জমি থেকে মাটি কাটায় তাকে একাধিবার নোটিশ করেছে কক্সবাজার সওজ বিভাগ। পরে রহস্যজনক ভাবে তারা নিরব হয়ে যান। সম্প্রতি আক্তার আবার ওই ইটভাটা শফিউলের কাছে ফিরিয়ে দেন বলে জানা গেছে।
রামু চাকমারকুল ইউনিয়নে বাঁকখালী নদীর পাড়ে রয়েছে এএনকে, এইচবিসি, এবিএ ও জেটএমএম নামের ব্রিকস ফিল্ড। এগুলোর কোন অনুমতি নেই। তাদের নিজস্ব অনুমতিতেই চলছে।
স্থানীয় কৃষক ও সাধারন লোকজনের অভিযোগ, সকাল বেলা কুয়াাশায় ইট ভাটার চিমনির ধোঁয়া অনেক নীচে নেমে আসে। ফলে ফসলি ও বাড়ি ঘরের গাছ পালা মরতে শুরু করেছে। আর ধোঁয়ার উৎকট গন্ধে শিশু সহ সকলেরই শ্বাস সমস্যা হচ্ছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় গ্রামবাসী সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাচ্ছে। মালিকদের অনেক বলেছি। তারা শুনেন না।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চাকমারকুল পানিছড়া সীমানা পর্যন্ত রয়েছে লাইসেন্স বিহীন অনেক গুলো ইটভাটা। তারা উপজেলা ও জেলায় সবকিছু ম্যানেজ করেই অনুমোদন বিহীন ব্যবসা করছেন বলে জানিয়েছেন ভাটা সংশিষ্ট একাধিক ব্যক্তি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটা সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, বিভিন্ন জাতীয় দিবস ছাড়া প্রতি মাসে ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা নেয় উপজেলা প্রশাসনের কতিপয় কর্মচারী। চাঁদা দেয়াই হচ্ছে ইটভাটার মালিকদের সকল অনিয়ম দূর্নীতি ও পরিবেশ বিধংসী কাজের বৈধতা পাওয়ার মুল হাতিয়ার।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের জানা মতে চুড়ান্ত ভাবে কয়েকটি ব্রিকসের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। এখানে কৃষি জমির পাশেই অবৈধভাবে অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে ওঠেছে। যার কারণে এলাকার কৃষি আজ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। কৃষি জমির পাশে ইটভাটা হতে পারে না।
এব্যাপারে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, আপনারা আমাদের একটা তালিকা দেন, সকল তথ্য ভালভাবে জেনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments